মুহতারাম মুফতি সাহেব! আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি কয়েক বছর আগে এবং আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে দুইটি সন্তানও রয়েছে। ইদানিং আমার প্রথম স্ত্রী বিষয়টি জেনে বলে যে " তুমি বলো! আমি ছাড়া তোমার অন্য স্ত্রী থাকলে সে তালাক। তখন তার কথায় আমি বলি, তুমি ছাড়া অন্য স্ত্রী থাকলে তাকে তালাক দিচ্ছি , তালাক, তালাক, তালাক।
এভাবে চার বা পাঁচবার তালাক শব্দটা বলি।
বি:দ্র: এ কথা বলার সময় আমার মনে কত তালাক দিবো সে সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ত ছিল না। এখন মুফতি সাহেবের কাছে জানার বিষয় হচ্ছে
১. এর দ্বারা আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর উপর কত তালাক পতিত হয়েছে? এবং
২. এ অবস্থায় আমাদের জন্য করণীয় কী?
বিবাহেচ্ছুক প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য বিবাহ-তালাক ও দাম্পত্য সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে শরীয়তের মৌলিক বিধান জেনে নেওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে অবহেলা করা গুনাহ। উপরন্তু এ বিষয়ে অবহেলা সংসার জীবনে অনেক সময় কঠিন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই গুনাহ ও বিপদ উভয় থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ হলেও শরীয়তের বিধান জেনে নেওয়া কর্তব্য। ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক, তাদের মাঝে গভীর ভালোবাসা বিশেষভাবে কাম্য। কেননা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের প্রভাব পরিবার, সংসার, সন্তানসহ আরো অনেক কিছুর উপর পড়ে। আর কোনো সন্দেহ নেই যে, দাম্পত্য হলো দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক দৃঢ় ও উন্নত হওয়ার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের আন্তরিকতা এবং কঠিন পরিস্থিতিতে একে অপরকে ছাড় দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
এর ব্যত্যয় ঘটলে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। এমনকি তা কখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তালাক পর্যন্ত গড়ায়। উল্লেখ্য, শরীয়তে তালাক মোটেও কাম্য নয়। এ জন্যই শরীয়তে তালাককে বৈধ কাজের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ বলা হয়েছে। আর তালাক এমন স্পর্শকাতর বিষয়, যা বলে ফেললে আর বাতিল করা যায় না এবং লিখিত কিংবা মৌখিক, স্ত্রীকে শুনিয়ে কিংবা না শুনিয়ে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, এমনকি ঠাট্টাচ্ছলে, রাগান্বিত অথবা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়। তাই শরীয়ত কর্তৃক নির্দেশিত প্রন্থায় স্ত্রীকে সতর্ক ও সংশোধন করার যেসব পদ্ধতি রয়েছে, পর্যায়ক্রমে সেসব প্রয়োগ না করেই তালাক দেওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনে কখনো তালাক দিলেও যেহেতু বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য এক তালাকই যথেষ্ট, তাই কোনো পরিস্থিতিতেই তিন তালাক না দেওয়া কর্তব্য। কেননা তিন তালাক দিলে আর স্বাভাবিকভাবে বিবাহের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। উপরন্তু এ কারণে অনেক সময় সামাজিক ও পারিবারিক এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় থাকে না। আর যারা বলে একসাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হয়, রাগান্বিত কিংবা গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে তালাক পতিত হয়না ইত্যাদি। তাদের এসব কথা সম্পূর্ণ ভুল ও কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থি। তাই এসব কথা কর্ণগোচর করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে সামাজিক লজ্জা ও পারিবারিক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করার চেয়ে পরকালের আজাব অনেক কঠিন।
এই কথাগুলো ভালোভাবে বুঝার পর কথা হলো এই যে, প্রশ্নোল্লিখিত সূরতে প্রশ্নকারী তার প্রথম স্ত্রী কর্তৃক দ্বিতীয় স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রথম স্ত্রীকে লক্ষ্য করে, " তুমি ছাড়া আমার অন্য স্ত্রী থাকলে তাকে তালাক দিচ্ছি , তালাক, তালাক, তালাক" একথা বলার দ্বারা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর উপর তিন তালাক পতিত হয়ে গেছে, এবং একে অপরের জন্য সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে গেছে। তাই তালাকের পর থেকে তাদের পরস্পরের মাঝে পর্দা রক্ষা করা আবশ্যক। এবং পূর্বের ন্যায় দেখা-সাক্ষাৎ, মেলামেশা তথা স্বামী-স্ত্রীসুলভ সকল প্রকার আচরণ তাদের জন্য হারাম। আর স্বামীর জন্য স্ত্রীর ইদ্দতকালীন সময়ের তথা তালাক পরবর্তী তিন মাসিক শেষ হওয়া পর্যন্ত, গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত। আর উভয়টির কোনোটি না হলে তিন মাস পর্যন্ত খোরপোষ দেওয়া এবং মোহর (আংশিক কিংবা পূর্ণ) আদায় না করে থাকলে তা আদায় করা ওয়াজিব। শরীয়তের বিধান অনুযায়ী এখন তাদের পুনর্বিবাহ বৈধ নয়। তবে যদি তিন তালাকের ইদ্দত শেষ হওয়ার পর স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং তার সাথে শারীরিক সম্পর্কও হয়, তারপর ঐ স্বামী মারা যায় বা কোনো কারণে তাকে তালাক দেয়, তাহলে দ্বিতীয় স্বামীর তালাক বা মৃত্যুজনিত ইদ্দত পালনের পর পূর্বের স্বামী এবং সে উভয়ে সম্মত থাকলে নতুনভাবে মোহর নির্ধারণ করে শরীয়ত সম্মত পন্থায় বিবাহ করতে পারবে। উপরোল্লিখিত পদ্ধতি ছাড়া তাদের ঘর-সংসার করার অন্য কোনো পথ বৈধ নয়।
قال ﷻ : فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ ۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يَتَرَاجَعَا إِن ظَنَّا أَن يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ ۗ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ. (سورة البقرة، الآية:-230)-
وفي سنن ابن ماجة : عن ابن عمر ـ رضي الله عنهما ـ قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: أبغض الحلال إلى الله الطلاق. (كتاب الطلاق ، ج:١، ص:٦٥٠، ط:دار إحياء الكتب العربية)-
و في الهداية : وإذا أضافه إلى الشرط وقع عقيب الشرط اتفاقا مثل أن يقول لامرأته: إن دخلت الدار فأنت طالق ولا تصح إضافة الطلاق إلا أن يكون الحالف مالكا أو يضيفه إلى ملك والإضافة إلى سبب الملك كالتزوج كالإضافة إلى الملك فإن قال لأجنبية: إن دخلت الدار فأنت طالق ثم نكحها فدخلت الدار لم تطلق كذا في الكافي". (کتاب الطلاق، الباب الرابع فی الطلاق بالشرط، ج:1، ص:420، دارالفکر)-
وفيها أيضا : ولا يفتقر إلى النية؛ لأنه صريح فيه لغلبة الاستعمال. (كتاب الطلاق،باب إيقاع الطلاق، ج:٢، ص:٣٥٩، ط:أشرفي)-
وفي الفتاوى الهندية : وإن كان الطلاق ثلاثاً في الحرة، وثنتين في الأمة لم تحل له حتى تنكح زوجاً غيره نكاحاً صحيحاً ويدخل بها، ثم يطلقها أو يموت عنها. (كتاب الطلاق ، الباب السادس في الرجعة، فصل فيما تحل به المطلقة، ج:١، ص:٤٧٣، ط:زكريا)-
وفي الفتاوى الهندية : وإذا أضافه إلى الشرط وقع عقيب الشرط اتفاقا مثل أن يقول لامرأته: إن دخلت الدار فأنت طالق ولا تصح إضافة الطلاق إلا أن يكون الحالف مالكا أو يضيفه إلى ملك والإضافة إلى سبب الملك كالتزوج كالإضافة إلى الملك فإن قال لأجنبية: إن دخلت الدار فأنت طالق ثم نكحها فدخلت الدار لم تطلق كذا في الكافي". (کتاب الطلاق،الباب الرابع فی الطلاق بالشرط،ج:1، ص:420، دارالفکر)-
وفي مجمع الأنهر: و لا يحتاج إلى نية؛ لأن الصريح موضوع للطلاق شرعاً، فكان حقيقة فاستغنى عن النية. (كتاب الطلاق، باب إيقاع الطلاق، ج:١،ص:٣٨٦، ط: دار الكتب العلمية، بيروت)-
وفي فتاوی دار العلوم : سوال ایک شخص نے اپنی زوجہ کو کہا کہ اگر تو بلا اجازت اپنے باپ کے گھر گی تو تجھ کو طلاق ہے، چنانچہ زوجہ پالا جازت چلی گئی تو طلاق واقع ہو گئی یا نہیں؟
الجواب اس صورت میں شرعا طلاق واقع ہو گئی۔ (ج:١٠، ص:١٤، ط:مکتبہ دار العلوم)-
و في فتاوى قاسمية : جب بکر نے اپنی بیوی کو ایک ہی سانس میں تین طلاق دیدیں، تو تینوں طلاقیں واقع ہو کر بیوی مغلظہ ہوئی چاہے بکر کی ان الفاظ سے طلاق دینے کی نیت ہو یا نہ ہو۔ (ج:١٤، ص:٥١٤، ط: أنوار القرآن)-